Breaking




Tuesday, 26 September 2023

বাংলা গদ্যের ক্রমবিকাশে ও সমাজ সংস্কারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান

বাংলা গদ্যের ক্রমবিকাশে ও সমাজ সংস্কারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান

বাংলা গদ্যের ক্রমবিকাশে ও সমাজ সংস্কারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান
বাংলা গদ্যের ক্রমবিকাশে ও সমাজ সংস্কারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান
সুপ্রিয় বন্ধুরা,
আজকে আমরা পড়বো এক মহান ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে। যিনি আমাদের বাংলার গদ্য সাহিত্য তথা সমাজ সংস্করণের ক্ষেত্রে বিশেষ ভুমিকা পালন করেছেন। যিনি আমাদের মনে আজও জায়গা করে আছেন, তিনি আর কেউ নন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। আমরা আজ ওনার সম্পর্কেই পড়বো। 

ভুমিকা 

উনবিংশ শতাব্দীর বাংলা গদ্য সাহিত্যের উন্নতিকল্পে  যিনি বিশেষ ভুমিকা নিয়েছিলেন তিনি হলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। রামমোহন রায় গদ্যকে একটি গ্রানিট স্তরে পৌঁছে দিলেও, সেই সদ্যজাত গদ্যে যথার্থ প্রান ছিল না। বিদ্যাসাগরই সেই গদ্যকে অবিচ্ছিন্ন ধ্বনিপ্রবাহ ও পরিনতি দান করে নতুনরুপে প্রান প্রতিষ্ঠা করেছেন। বাংলা গদ্যের মধ্যে যে প্রচ্ছন্ন ধ্বনিপ্রবাহ আছে , সেটাই বিদ্যাসাগর প্রথম অনুভব করেছিলেন। তাই বাংলা চলিত গদ্যে ছেদ, যতি, কমা, ছন্দ, ইত্যাদির ব্যাবহার করে। তিনিই গদ্যের জনক হিসাবে পরিগনিত হয়েছিলেন, অন্যদিকে বিধবা বিবাহ আন্দোলন , বহুবিবাহ রোধ , স্ত্রী শিক্ষার প্রসার প্রভৃতি আন্দলনের সঙ্গে যুক্ত থেকে নিজেকে একজন সমাজ সংস্কার হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন ,''বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যের জনক,'' - রবিন্দ্রনাথের এই অভিমত সামনে রেখে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের গদ্যরীতি আলোচনা করা যেতে পারে।

বাংলা গদ্যের ক্রমবিকাশে ঈশ্বরচন্দ্র

বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যের রীতিকে নতুন ভাবে গড়ে তোলার দায়িত্ব নিয়েছিলেন । ভাষাতাত্ত্বিক রীতি অনুসরণ করে তিনি বাংলা গদ্যের ধারাকে যেভাবে তুলে ধরেছিলেন , তাঁর রচনারীতিকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করে নেওয়া যায় --

অনুবাদ মূলক রচনা ঃ- বাসুদেবচরিত (কৃষ্ণলীলা অবলম্বনে রচিত, পরে গ্রন্থটি পাওয়া যায়নি), বেতালপঞ্চবিংশতি (১৮৪৭ খ্রি ঃ), এটি হিন্দি, ''বৈতালপচ্চিসি'' থেকে অনুবাদ, এটি বিদ্যাসাগরের প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ, '' শকুন্তলা '' (১৮৫৪ কালিদাসের '' অভিজ্ঞানশুন্তলা'' নাটক অবলম্বনে রচিত)'' সীতার বনবাস '' (১৮৬০ খ্রিঃ মার্সম্যানের ''হিস্ট্রি অব বেঙ্গল'' অবলম্বনে রচিত), ''ভ্রান্তিবিলাস'' (৯১৮৬৯ খ্রিঃ এটি শেক্স পিয়রের ''Comedy Of  Errors'' অবলম্বনে রচিত) 

 মৌলিক রচনাঃ-  ''সংস্কৃত ভাষা ও সংস্ক্রিত সাহিত্য'' শাস্ত্র বিষয়ক প্রস্তাব (১৮৫৩ খ্রিঃ), "বিধবা বিবাহ চলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব'' দুই খণ্ড - ১ম খণ্ড ১৮৫৩ খ্রিঃ, ২য় খণ্ড ১৮৫৫ খ্রিঃ), ''বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার " (দুই খণ্ড - ১ম খণ্ড ১৮৭১ খ্রিঃ, ২য় খণ্ড ১৮৭৩ খ্রিঃ), "প্রভাবতী সম্ভাষণ'' (১৮৬৩ খ্রিঃ), "বিদ্যাসাগরচরিত" (১৮৯১ খ্রিঃ)।

 ছাত্রপাঠ্য বা শিশুপাঠ্য মূলক রচনা ঃ-  ''বর্ণপরিচয়'', (১ম ভাগ -১৮৫৩ খ্রিঃ, ২য় ভাগ - ১৮৫৫ খ্রিঃ), "বোধদয়" (১৮৫১ খ্রিঃ) , "কথামালা" (১৮৫৬ খ্রিঃ)
এছাড়াও তিনি কিছু সমালোচনামূলক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন , যেমন - ''অতিঅল্প হইল '' (১৮৭৩ খ্রিঃ) , আবার অতি অল্প হইল (১৮৭৩ খ্রিঃ)
বিদ্যাসাগর ছিলেন মুলত অনুবাদক, তবে অনুবাদ মূলক গ্রন্থও যে রচনার গুন মৌলিক সাহিত্য হয়ে উঠতে পারে তা বিদ্যাসাগরই প্রথম দেখিয়েছিলেন, বিশেষ করে '' শকুন্তলা'', " সীতার বনবাস '' গ্রন্থগুলিকে ভাবানুবাদ করে পাঠকের কাছে  জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। এর পাশাপাশি মৌলিক রচনা, শিশুপাঠ্য রচনা ও সমালোচনা মূলক রচনাতেও নিজস্ব ভাবনা এবং গদ্যের উপযুক্ত রীতি যুক্ত করে সেই সময়ের পাঠকের কাছে তিনি গ্রন্থগুলিকে উপযোগী করে তুলেছিলেন।

 বিদ্যাসাগরের বাংলা গদ্যরীতিতে অবদান ঃ-  
● বিদ্যাসাগরের গ্রন্থ তৎভব শব্দের তুলনায় তৎসম শব্দের ব্যবহার বেশি দেখা যায়। এজন্য শিশুপাঠ্য রচনায় দেশীয় শব্দ বেশি ব্যবহার করেছেন। 
● তাঁর গ্রন্থের নাম ধাতুর ব্যাবহার বেশ লক্ষ্য করা যায়।  তাই একাধিক গ্রন্থে ''জিজ্ঞাসিলেন '', '' জিজ্ঞাসা করিলেন'' -এ জাতীয় নামধাতু ব্যাবহার করেছেন। এই শব্দ ব্যবহারে বাংলা সাধু গদ্যে প্রান ফিরে এসেছে।
● বাংলা সাধু গদ্যের ধারায় ভাব অনুযায়ী "পদ" ও ''বাক্যের" গঠন বিদ্যাসাগরই প্রথম দেখিয়েছেন।
● বাংলা সাধু গদ্যের ধারায় সুরের তরঙ্গ ও ছন্দের লালিত্য প্রথম এনেছেন বিদ্যাসাগর।
● দীর্ঘ সমাসবদ্ধ পদকে সহজ শব্দে অপূর্বভাবে বিদ্যাসাগর তাঁর ''সীতার বনবাস'' গ্রন্থে এনেছেন - ''এই যে জন্মস্থান মধ্যবর্তী প্রসবনগিরি, যা শিখর দেশ সতত সঞ্ছারমান।''

সমাজ সংস্কারে ঈশ্বরচন্দ্র

উনবিংশ শতাকে ভারতের বিরল যে কয়েরজন ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ সংস্কারকের আবির্ভাব ঘটেছিল , তাদের মধ্যে সরবশ্রেষ্ঠ পণ্ডিত ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র। সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রে তাঁর আবদান গুলি হল নিম্নরূপ -

 শিক্ষার সংস্কারঃ-  উনিশ শতকে শিক্ষা সংস্কার আন্দোলনে অন্যতম পুরধা ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনি ১৮৪৯ খ্রিঃ "ক্যালকাটা ফিমেল স্কুলের " স্থাপন করেন, তিনি বর্ণ, বৈষম্য দূর করে সকলের জন্য শিক্ষার অধিকারের কথা বলেন। তিনি জনশিক্ষার জন্য কথামালা, ''বোধোদয়'', "বর্ণমালা" প্রভৃতি পুস্তক রচনা করেন। এছাড়া তিনি "শিক্ষার - শিক্ষণ বিদ্যালয় "প্রতিষ্ঠা করেন এবং তিনি বেশ কয়েকটি বিখ্যাত বইয়ের বাংলা অনুবাদ করেন" তিনি অধ্যাপক হাজিরা ও ছুটির নিয়মের প্রথা চালু করেন।

 বিধবাবিবাহঃ-  বিধবাবিবাহ প্রশ্নকে কেন্দ্রকরে এক ব্যাপক আন্দলনের সুচনা করেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। ''তত্ত্ববধিনি'' পত্রিকা তিনি এ বিষয়ে তিনি এক দীর্ঘ প্রবন্ধ লেখেন, এই উদ্দেশ্যে সরকারের কাছেও জনস্বাক্ষরিত বহুপত্র পত্রিকা পাঠান, শেষপর্যন্ত ১৮৫৬ খ্রিঃ রক্ষণশীল, হিন্দুগোঁড়া নেতাদের প্রবল বিরোধীতার সত্ত্বেও লর্ড ডাল হৌসির সহায়তায় বিধবাবিবাহ আইন শুরু করেন। 

 বাল্যবিবাহ বিরোধী আন্দোলন ঃ- বিদ্যাসাগর বাল্যবিবাহকে তত্ত্বকালীন হিন্দুসমাজে অভিশাপ স্বরূপ প্রত্যক্ষ করেছেন। তিনি ''সর্বশুভঙ্করী পত্রিকায় বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে জনমত গঠন ও আন্দোলন শুরু করেন। এই আন্দোলনের ফলে পরবর্তীকালে সরকার মেয়েদের বিয়ের বয়স বাড়িয়ে ছিল।

 বহুবিবাহের বিরধিতা ঃ- ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর হিন্দুসমাজের বহুবিবাহ প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। কুলিন ব্রহ্ম অর্থলোভ লালশায় পড়ে বহুবিবাহ করত। এই প্রথার বিরুদ্ধে ১৮৫৫ খ্রিঃ বর্ধমানে মহারাজার সহযোগীতায় ৫০ হাজার মানুষের স্বাক্ষর যুক্ত একটি পতিবাদ পত্র, সকারের কাছে প্রেরন করেন, ফলস্বরূপ ১৮৫৭ খ্রিঃ পরবর্তী সময়ে ভারতীয়দের সামাজিক ও ধর্মীয় বিষয়ে ইংরেজরা হস্তক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। যদিও তারা কার্যকর হয়নি, বিদ্যাসাগর ১৮৭১ খ্রিঃ দুটি পুস্তিকা প্রকাশ করে বলেন বহুবিবাহ বেআইনি।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর শিক্ষাবিদ ও সমাজ সংস্কার ছাড়াও বহুমুখি কাণ্ড পরিচালনা করেন, তাঁর প্রশংসার দাবী হিসাবে মানব প্রতি উল্লেখযোগ্য।
পরিশেষে বলা যায়, বিদ্যাসাগরের কৃতিত্ব বাংলা গদ্যরীতি ও সমাজ সংস্কারে সার্থকভাবে প্রকাশ পেয়েছে। যদিও সমাজ সংস্কারক হিসাবে নিজেকে সার্থকভাবে তুলে ধরেছেন। তাই আলোচনার শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে তাঁর গ্রন্থগুলি অনুধাবক করে এটাই বলা যায় যে, বাংলা সাধু গদ্যরীতিকে তিনিই প্রথম একটা স্থাইয়িরুপ দিয়েছেন। আর এই সমস্ত দিক লক্ষ্য করেই রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বিশেষ ভাষায় মুল্যায়ন করে বলেছেন -" বাংলা গদ্যের প্রকৃত জনক।"

আশা করছি তোমাদের সঙ্গে সুন্দর ভাবেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সমাজ সংস্কার এবং বাংলা গদ্য কাব্যের ক্রমবিকাশের দিকটি তুলে ধরতে পেরেছি। কেমন লাগলো তোমাদের অবশ্যই জানাবেন, যদি ভাল লেগে থাকে শেয়ার করতে ভুলবেননা। ধ্যনবাদ 

No comments:

Post a Comment